শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে
Call

সংস্কৃতি আসলে একটা দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার, একটি জীবনবোধ বিনির্মাণের কলাকৌশল। এটি মানুষের জীবনের একটি শৈল্পিক প্রকাশ, সমাজ জীবনের স্বচ্ছ দর্পণ। এ সংস্কৃতির দর্পণে তাকালে কোন সমাজের মানুষের জীবনাচার, জীবনবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। অন্য কথায়, সমাজ মানুষের জীবনাচার, দৃষ্টিভঙ্গী আর বোধ- বিবেচনা থেকেই সে সমাজের সংস্কৃতি জন্মলাভ করে। তবে সংস্কৃতি এমন কোন জিনিস নয় যে, এটি একবার ছাচে তৈরি হবে, তার কোন পরিবর্তন করা যাবে না। বরং সমাজ ও জীবনের পরিবর্তনর এবং সময়ের ধারায় এ সংস্কৃতি পরিআতিত হতে পারে। এমন কি অন্য কোন সংস্কৃতির সংস্পশে এসে পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে নতুন নতুন উপাদান সংগ্রহ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে। এমন কি অন্য কোন সংস্কৃতির সংস্পশে এসে পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে নতুন নতুন উপাদান সংগ্রহ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে। অন্যদিকে ভিনদেশী সংস্কৃতির তোড়ে নিজের সংস্কৃতির অস্তিত্ব হারিয়েও ফেলতে পারে। আর দুভাগা পরিণতি যে সমাজের হয় সে সমাজেই সাংস্কৃতিক বন্ধাত্বের জন্ম হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের সমাজে ঠিক তাই ঘটেছে। মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির তোড়ে নিজের সংস্কৃতির নামে স্যাটেলাইটের নগ্ন আর আস্তবাদী সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে এমন আঘাত করেছে যে তোড়ে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির নাভীশ্বাস উঠেছে। সাংস্কৃতি আদান-প্রদানের মুক্তবাজারে আমরা মার খেয়ে বসেছি।পশ্চিমা চটকদার সংস্কৃতি আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। ফলে আমরা আমাদের স্বকীয়তা হারিয়ে ক্রমেই সাংস্কৃতিক দৈন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছি। মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যে রঙীন জীবনবোধ তা আমাদের দেশীয় জীবনবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকেও প্রতিনিয়ত আঘাত করছে অপসংস্কৃতি রূপে স্যাটেলাইটে প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে বস্তুবাদিতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, আর নগ্নতার হাজারোপাঠ।এই সব অপসংস্কৃতির রঙ্গীন বিষয়বস্তু অনেক রঙ ঢঙ আর লালসার আবরণ লাগিয়ে পসরা সাজিয়ে ধরছে আমাদের সামনে। ফলে মনের অজান্তেই আমরা ছুটছি এই স্বপ্নিল ভুবনের দিকে। হারিয়ে ফেলছি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব জীবনবোধ। আমাদের এই আত্মবিস্মৃতিই আমাদেরকে প্রিতিনিয়ত হতাশার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে এর প্রভাব পড়েছে সমাজে ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।

যা প্রত্যক্ষ, যাকে স্পর্শ করা যায়, যার আকার-আকৃতি আছে, সেগুলোই বস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে। আর অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে নাচ, গান, অভিনয় প্রভৃতি। এগুলোকে দেখা যায়, শোনা যায় এবং অনুভব করা যায়। বেশিরভাগ মানুষই ধরে নেয়, নাচ, গান, নাট্যাভিনয় কিংবা যাত্রাই হলো সংস্কৃতি। কুমোর যখন মাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে, তার মধ্যে সে অনেক রকমের শিল্পকর্মের ছোঁয়া দেয় কিংবা সে যখন কাঠ, খড়, মাটি দিয়ে একটি প্রতিমার কাঠামো নির্মাণ করে, তখন তা হয়ে থাকে শুধুই বস্তু, কিন্তু তার ওপরে রঙের প্রলেপ দিয়ে সে যখন তাকে সম্পূর্ণ একটি প্রতিমা করে তোলে এবং পুরোহিত যখন তাতে প্রাণের প্রতিষ্ঠা করে বলে ধারণা করা হয়, তখন আর সেটি বস্তু থাকে না, বস্তুরও অধিক একটি নতুন শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে, যা বস্তুগত সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে অবস্তুগত সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে যায়।

ইংরেজি Culture-এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়। [১] কোন স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত , নৃত্য , সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা -দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হল টিকে থাকার কৌশল এবং পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র সংস্কৃতিবান প্রাণী। মানুষের এই কৌশলগুলো নির্ভর করে ভৌগোলিক, সামাজিক, জৈবিকসহ নানা বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে

ARZU

Call

সংস্কৃতির ধারণা: সংস্কৃতি হচ্ছে Culture শব্দের বাংলা রূপায়ন। এটি এসেছে ল্যাটিন Colere থেকে। সংস্কৃতি শব্দটি প্রথম চালু করেন রবীন্দ্রনাথ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় 1920 এর দশকে। ইংরেজি সাহিত্যে Culture শব্দের প্রথম আমদানি করেন ফ্রান্সিস বেকন। সংস্কৃতি হলো সমাজস্থ মানুষের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিচয়ের সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবহ একটি উপাদান। মানবেতর প্রানীদের মধ্যে সমাজবদ্ধতার সন্ধান পাওয়া যায় কিন্তু সংস্কৃতি অনুপস্থিত। নৃবিজ্ঞানী ফ্রাঞ্জ সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেন, “সমাজের প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি ব্যক্তি বিশেষের যে প্রক্রিয়া এই দু’য়ের সংমিশ্রনে যা সৃষ্টি হয় তাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্যঃ ১। সংস্কৃতি শিখতে হয়। ২। সংস্কৃতি ধারণা লব্ধ জিনিস। ৩। সংস্কৃতি সামাজিক ৪। সংস্কৃতি আদর্শ ধারণ বিশিষ্ট ৫। সংস্কৃতি বাসনা চরিতার্থ কারক ৬। সংস্কৃতি উপযোগীকরণ যোগ্য ৭। সংস্কৃতি অখন্ডিত ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে সংস্কৃতি অর্থ সুসভ্য আচরণ, শিষ্টাচার ও উন্নত নৈতিক মূল্যবোধ; যার ভিত্তি হচ্ছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। ইসলামী সংস্কৃতি হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত পয়গাম ও ইসলামী শরীয়তের বুনিয়াদে মানুষের সামাজিক জীবনের সৌজন্যমূলক আচরণ, শিষ্টাচার, সৎকর্মশীলতা ও উন্নত নৈতিকতাকে বুঝায়।

Call

ব্যক্তিদের সূক্ষ্ণ ও সুকোমল আবেগ-অনুভূতি এবং হৃদয় আত্মার দাবি ও প্রবণতা পূর্ণ করে যেসব উপায়-উপকরণ, তা- ই হচ্ছে সংস্কৃতি। সঙ্গীত, কবিতা, ছবি অংকন, ভাস্কর্য, সাহিত্য, ধর্মবিশ্বাস, দার্শনিক চিন্তা প্রভৃতি এক-একটা জাতির সংস্কৃতির প্রকাশ-মাধ্যম এবং দর্পণ। কোন বাহ্যিক ও বৈষয়িক উদ্দেশ্য লাভের জন্যে এসব তৎপরতা সংঘটিত হয় না। আত্মিক চাহিদা পূরণই এগুলোর আসল লক্ষ্য। এসব সৃজনধর্মী কাজেই অর্জিত হয় মন ও হৃদয়ের সুখানুভূতি-আনন্দ ও উৎফুল্লতা। একজন দার্শনিকের চিন্তা ও মতাদর্শ, কবির কাব্য ও কবিতা, সুরকার ও বাদ্যকারের সুর-ঝংকার-এসবই ব্যক্তির হৃদয়-বৃত্তির বহিঃপ্রকাশ। এসবের মাধ্যমেই তার মন ও আত্মা সুখ-আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করে। এসব মূল্যমান, মূল্যবোধ, হৃদয়ানুভূতি ও আবেগ-উচ্ছ্বাস থেকেই হয় সংস্কৃতির রূপায়ন। নৃবিজ্ঞানী টেইলরের ভাষ্যমতে, “সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা এবং জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয় হল সংস্কৃতি।” ম্যালিনোস্কির বক্তব্যমতে, “সংস্কৃতি হল মানব সৃষ্ট এমন সব কৌশল বা উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে।”