শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, মিলাদ-কিয়াম বিদআত। কেননা আল্লাহর কিতাব, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত, সাহাবাদের আমল এবং সম্মানিত তিন যুগের কোন যুগে এর কোন অস্তিত্ব ছিলনা। তাই আমরা এটাকে বিদআত বলি। কারণ যে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হবে, কোরআন বা সুন্নাহয় অবশ্যই তার পক্ষে দলীল থাকতে হবে। আর মিলাদ-কিয়ামের পক্ষে এরকম কোন দলীল নেই বলেই এটি একটি বিদআতী ইবাদত। মূলতঃ হিজরী ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত এ ধরনের মিলাদ কোথাও অনুষ্ঠিত হয়নি। ৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর পর বাদশা মুজাফফররুদ্দীন আবু সাঈদ কৌকরী বিন আরবাল তিনি আমোদ-প্রমোদের জন্য এ বিদাতের সর্বপ্রথম উদ্ভোধন করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ১৩/১৫৯) যার প্রকৃত ইতিহাস এই– মিলাদের ইতিহাস বাদশা মুজাফফর ছিলেন একজন অপব্যয়ী শাসক। রাষ্ট্রীয় অর্থ তিনি সীমাহীনভাবে খরচ করতেন। মিলাদ-অনুষ্ঠানের প্রসার ও প্রচলনে অঢেল অর্থ খরচ করতেন। ইতিহাসবেত্তা ইমাম যাহাবী রহ. বলেন, তার মিলাদ মাহফিল-কাহিনী ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়। মিলাদ অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য ইরাকের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে এমনকি আলজেরিয়া হতেও মানুষের সমাগম ঘটত । মিলাদের দিন তার ও তার স্ত্রীর জন্য সুরম্য কাঠের গম্বুজাকৃতির তাঁবু তৈরী করা হত। সেখানে গান বাজনা ও খেলাধুলার আসর জমত। মুজাফফর প্রত্যহ আসরের পরে সেখানে আসত এবং অনুষ্ঠান উপভোগ করত। অনুষ্ঠান কয়েক দিন যাবত চলত। অসংখ্য পশু জবাই করে আগত ব্যক্তিদের জন্য ভোজসভার আয়োজন করা হত।  এ উপলক্ষে সে তিন লাখ দিনার বাজেট পেশ করত। ফকির-দরবেশদের জন্য দু’ লাখ এবং অতিথিদের জন্য এক লাখ দিনার। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা করেন, আমি দস্তরখানায় বিশেষ প্রজাতির একশত ঘোড়া, পাঁচ হাজার বকরীর মাথা, দশ হাজার মুরগি, এক লাখ গামলা, এবং তিন হাজার হালুয়ার পাত্র গণনা করেছি। (আল মিনহাজুল ওয়াজিহ ১৬২) অন্যদিকে যে আলেম প্রচলিত মিলাদ প্রবর্তনে সাহায্য করেন তার নাম মাজদুদ্দিন আবুল খাত্তাব উমার বিন হাসান বিন আলী বিন জমায়েল। তিনি নিজেকে সাহাবী দাহেয়াতুল কালবি রাযি. এর বংশধর বলে দাবি করেন। অথচ তা ছিল মিথ্যা দাবি। কারণ দাহেয়াতুল কালবি রাযি. কোনো উত্তরসূরী ছিল না। তাছাড়া তার বংশধারায় মধ্যস্তন পূর্বপুরুষরা ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত হয়েছিল। উপরন্তু উক্ত আলেমের পেশকৃত বংশধারায় অনেক পুরুষের উল্লেখ নাই। (মিজানুল ইতিদাল ১/১৮৬) উক্ত সরকারি দরবারী আলেম একটি পুস্তকও রচনা করেছিলেন। যে পুস্তকে মিলাদের রূপরেখা বর্ণনা করা হয়েছিল। ৬০৪ হিজরীতে শাসক মুজাফ্ফারকে পুস্তকটি উপহার দেন। এতে সে খুশি হয়ে তাকে দশ হাজার দিনার বখশিশ দেয়। এভাবে এখান থেকেই মিলাদুন্নবী উদযাপনের সূচনা হয়। (টিকা সিয়ারু আলামিন্নুবালা ১৫/২৭৪) মিলাদপ্রথা আবিস্কারের পরে সে সময়ের মানুষ বছরে একটি দিনে (১২ রবিউল আউয়াল) তা উদযাপন করত এবং কয়েকদিন ধরে চলত। পরবর্তীতে কিছু মানুষ এটাকে সওয়াবের কাজ মনে করে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে উদযাপন করতে শুরু করে। আগে বড় ধরনের মাহফিলের আয়জন করা হত। বর্তমানে মনগড়া কিছু দুরুদ ও গজল গেয়ে শেষ করা হয়। কিয়ামের ইতিহাস প্রচলিত মিলাদের সাথে আরেকটি প্রথা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে  জুড়ে দেয়া হয়েছে। যার নাম দেয়া হয়েছে কিয়াম। এটি মিলাদের পরে আবিষ্কৃত হয়েছে। ৭৫১ হিজরির কথা। খাজা তকিউদ্দিন ছিলেন একজন ভাব কবি ও মাজযুব  ব্যক্তি। নবীজীর শানে তিনি কিছু কাসিদা (কবিতা) রচনা করেন। বরাবরের ন্যায় একদিন তিনি কাসিদা পাঠ করছিলেন এবং ভাবাবেগে হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে কাসিদা পাঠ করতে লাগলেন। ভক্তরাও তাঁর দেখাদেখি দাঁড়িয়ে গেল। ঘটনা এখানেই শেষ। তিনি আর কখনো এমনটি করেন নি। এখানে একটা বিষয় লক্ষনীয় যে, খাজা তকিউদ্দিন কবিতা পাঠ করতে করতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। এটি কোন মিলাদের অনুষ্ঠান ছিল না। তিনি অনিচ্ছাকৃত দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু মিলাদের জন্মের একশত বছর পরে বিদআতপন্থীরা এটিকে মিলাদের সাথে জুড়ে দেয়। ফলে কিয়ামজাত মিলাদ বিদআত হওয়ার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, সুতরাং ইসলামের চার খলিফার যুগ শেষ হয়ে আরো ৫ পাচঁ শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার পর ৬০৪ হিজরী সনে ইরাকের মুসেল শহরের বিলাসপ্রিয় ও ধর্মদ্রোহী বাদশা মুজাফফররুদ্দীন আবু সাঈদ কৌকরী বিন আরবাল এর নির্দেশে এক স্বার্থবাদী আলেম আবুল খাত্তাব উমার বিন হাসান বিন আলী বিন জমায়েল কর্তৃক উদ্ভাবিত মিলাদ নামক এই বিদআত এবং তারও একশত বছরের পরে আবিস্কৃত কিয়াম নামক এই বিদআত  গ্রহন করার কোন অর্থই হতে পারে না। বরং কয়েকটি কারণে একে সাওয়াবের কাজ মনে করে করা হল বড় বিদআত। প্রথম কারণ: আল্লাহ তা’আলা বলেছেন-وَمَآ ءأتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا অর্থাৎ, রাসূল যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক। (সূরা হাশর : ৭) দ্বীতিয় কারণ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ  অর্থাৎ, যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু প্রবর্তন করে যা এর অন্তর্ভূক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত। (বুখারী ২৬৯৭; মুসলিম ১৭১৮) তৃতীয় কারণ: অন্যত্র তিনি বলেছেন- فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ অর্থাৎ, তোমাদের জন্য আবশ্যক আমার ও আমার পরবর্তী হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরা যেভাবে দাঁত দিয়ে কোন জিনিস দৃঢ়ভাবে কামড়ে ধরা হয়। আর শরীয়তে নিত্য নতুন জিনিস আবিস্কার করা হতে বেঁচে থাক। কেননা সকল নবসৃষ্ট বস্তুই বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী। (আবু দাউদ ৪৬০৭) আর আমরা জানি, আমাদের নবী সকল নবীদের মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ। তিনি সবার চেয়ে অধিকতর পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের পয়গাম পৌঁছিয়েছেন। যদি মিলাদ-কিয়াম আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত দ্বীনের অংশ হত আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কারণ হত, তাহলে অবশ্যই তিনি তা উম্মতের জন্য বর্ণনা করতেন বা তাঁর জীবনে একবার হলেও আমল করে দেখাতেন এবং তাঁর সাহাবীগণ বিশেষত খোলাফায়ে রাশেদা অবশ্যই তা করতেন। যেহেতু তাঁরা এমনটি করেছেন বলে বিদআতিদের কিছু মিথ্যা ও বানোয়াট কথা ছাড়া নির্ভরযোগ্য একটি বর্ণনাও পাওয়া যায় না, তাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের সাথে এই মিলাদ-কিয়ামের কোন সম্পর্ক নেই বরং এটা বিদআত, যা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে সাবধান থাকতে বলেছেন। চতুর্থ কারণ: মিলাদ মাহফিলের মত বিদআত আমলের আবিস্কারের মাধ্যমে এ কথা প্রতীয়মাণ হয় যে, আল্লাহ তা’আলা দ্বীনকে এ উম্মতের জন্য পরিপূর্ণ করেন নি, তাই দ্বীনের পরিপূরক কিছু আবিস্কারের প্রয়োজন হয়েছে। তেমনি একথাও বুঝা যায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের জন্য কল্যাণকর সকল বিষয়ের তাবলীগ বা প্রচার করেন নি। যে কারণে পরবর্তীতে আল্লাহর অনুমোদন ব্যতিরেকে শরীয়তে নতুন কিছু আবিস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চায়। এটা চুড়ান্ত পর্যায়ের অন্যায় ও ভুল। এটা আল্লাহর দুশমন ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান কর্তৃক তাদের ধর্মে নবপ্রথা সংযোজনের সাথে সামঞ্জস্য স্বরূপ এবং আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর একধরণের অভিযোগও বটে! অথচ আল্লাহ তা’আলা তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ ও বান্দাদের জন্য সকল নিয়ামত সস্পূর্ণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন- اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكَمْ نعْمَتِيْ وَ رَضِيْتُ لَكُم الإِسْلامَ دِيْنًا আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম ও আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা  মায়েদা: ৩) প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, আফসোস ও বিস্ময়কর ব্যাপার হল, এরূপ বিদআতি অনুষ্ঠান এমন সব মুসলমান দ্বারাও সংঘটিত হচ্ছে, যারা নিজদেরকে সুন্নি দাবি করে। তাকে বলতে হবে, যদি তুমি সুন্নি ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসারী হওয়ার দাবী রাখ, তাহলে বল, তিনি স্বয়ং বা তাঁর কোন সাহাবী বা তাঁদের সঠিক অনুসারী কোন তাবেয়ী কি একাজটি করেছেন? না এটা ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান বা তাদের মত আল্লাহর অন্যান্য শত্রুদের অন্ধ অনুকরণ? এধরণের মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর প্রতি ভালবাসা প্রতিফলিত হয়না। যা করলে ভালবাসা প্রতিফলিত হয়, তা হল তাঁর নির্দেশের অনুসরণ করা, তাঁর শিক্ষা দেয়া দুরূদ পাঠ করা, তাঁর সুন্নাতের প্রতি যত্নবান হওয়া, তিনি যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করা, যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করা। আল্লাহ যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, কেবল সেভাবেই তাঁর উপাসনা করা। মনে রাখতে হবে, কুরআন ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং খোলাফায়ে রাশেদীন ও তাবেয়ীদের প্রদর্শিত পথে চলার ভিতরেই রয়েছে মুসলমানদের জন্য ইহ ও পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তি। আল্লাহ সকলকে সহিহ বুঝ দান করুন। আমীন।

ভিডিও কলে ডাক্তারের পরামর্শ পেতে Play Store থেকে ডাউনলোড করুন Bissoy অ্যাপ