৪র্থ শিল্প বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করছে করোনার ফলে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি :

চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে দক্ষ হয়ে ওঠার এখনই সময়

৩য় শিল্প বিপ্লব উত্তরোত্তর পৃথিবীর দিকে দিকে যখন ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের (4th Industrial Revolution) দামামা বাজতে শুরু করেছে, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্বের প্রায় সব দেশ যখন নিজ নিজ জনশক্তি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রযুক্তির জ্ঞান ও তার সঠিক ব্যবহারে দক্ষ করে তোলার প্রয়াসে সচেষ্ট, ঠিক তখনই করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি বিশ্ববাসীকে এক নতুন পৃথিবীর ধ্যান-ধারণা দিতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য ও জীবন রক্ষায় মানুষের চাল-চলন, রুচি-অভ্যাস, পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা, গণপরিবহন ও রাস্তায় চলাচলের আদবকেতা এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে নানা পরিবর্তন এসেছে। এসব ইতিবাচক পরিবর্তন মানুষের মধ্যে স্থায়ী হবে বলেই মনে হয়। শুধু করোনা কেন, যেকোনো ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে মানুষের মধ্যে এসব বিষয়ে সুঅভ্যাস ও সচেতনতা স্বভাবজাত হিসেবে স্থায়ী রূপ পাওয়া অতীব জরুরী।  

অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ নয়, স্বাস্থ্য জয়ের নেশায় মানুষ এখন বিভোর। কাজেই পৃথিবীর বর্তমান উন্নততর মানবসভ্যতার ধারা টিকিয়ে রাখতে মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টি এখন প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সব দেশে সরকার প্রধানরাও জনস্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে দেখছে এবং দেখবে। এরই অংশ হিসেবে বর্তমান করোনাকালে, এমনকি করোনা পরবর্তীতেও অন্য যেকোনো রোগ-ব্যাধির সংক্রমণ ঠেকাতে সর্বক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্বের (Social Distance) বিষয়টি গুরুত্বের সাথে সামনে উঠে এসেছে। জীবন বাঁচাতে মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে মারাত্মক সংকটে পড়েছে মানুষের জীবিকা। প্রশ্ন উঠেছে, জীবন রক্ষা করবো নাকি জীবিকা? আসলে আমাদের দুটোই রক্ষা করতে হবে। এমনই অভ্যাসগত ও পরিবেশবান্ধব একটা সমাজব্যবস্থা আমাদের দরকার।

বর্তমান করোনার প্রকোপ খুব অল্প সময়ে আমাদের এ বিশ্ব সমাজ থেকে নির্মূল হয়ে যাবে- এটা যেমন আশা করা যায়না, তেমন করে সামাজিক দূরত্বের নামে দীর্ঘ সময় ধরে হাত গুটিয়ে বদ্ধ ঘরে থাকাও সম্ভব নয়। জীবন ও জীবিকা দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে চলতে হবে। কাজেই মানুষে মানুষে নিরাপদ দূরত্ব বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই আমাদের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, কলকারখানা, বাজার, শপিংমল প্রভৃতি কিভাবে চালু রাখা যায়- তা ভাবার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে অটোমেশন ও প্রযুক্তির সুব্যবহার আমাদের আশার আলো দেখায়। এ অর্থে করোনার ফলে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি যেন পূর্ণমাত্রায় ৪র্থ শিল্প বিপ্লব সংঘটনের প্রয়োজনকে ত্বরান্বিত করছে।  

৪র্থ শিল্প বিপ্লব মানে হলো এ.আই. (Artificial Intelligence) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক প্রযুক্তি নির্ভর একটি রোবোটিক বিশ্ব। যার মূল কথা হচ্ছে, সর্বত্র অটোমেশন বা এ.আই. প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার। ফলে গার্মেন্টস ও কলকারখানার লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কাজ করবে রোবট। নিজের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে রোবট করে দিবে মানুষের বাজার-সদাই। ঘরে বসেই মানুষ নিয়ন্ত্রণ করবে রাস্তার যানবাহন। অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করবে বিশেষ বিশেষ ড্রোন। কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার হবে অত্যাধুনিক অটোমেটেড যন্ত্রপাতি। অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবই চলবে অনলাইন ভিত্তিক। মানুষ ঘরে বসেই অনলাইনে পাবে সরকারি-বেসরকারি সেবাসমূহ। ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা সবই থাকবে ইন্টারনেট বা অন্তর্জালে সংযুক্ত। এক কথায়, সর্বত্র প্রযুক্তির ব্যবহার ভিত্তিক একটি বিশ্ব ব্যবস্থা। যেখানে মানুষের ব্যাপক সমাগমের প্রয়োজন হবেনা। প্রায়ই কাজই হবে রোবটের মাধ্যমে বা অনলাইনে। মানুষ শুধু দক্ষতার সাথে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঘরে বসে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। এতে করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই অর্থনীতির চাকা পূর্ণগতিতে সচল রাখা যাবে। জীবন ও জীবিকা দুটোই ভালোভাবে রক্ষা পাবে। চলমান ৪র্থ শিল্প বিপ্লব সাধনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ক্রমান্বয়ে এমন একটি ব্যবস্থাপনার দিকেই দ্রুত এগিয়ে চলছে। এ বিপ্লব যতই বেশি পূর্ণমাত্রায় রূপ পেতে থাকবে, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে জীবন চলা ততই সহজ হয়ে উঠবে। ফলে বর্তমান করোনা কালের মতো যেকোনো দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে জীবন ও জীবিকা উভয়ই রক্ষা করা মানুষের জন্য সহজ হবে।  

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো এ.আই. প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভালো মাত্রায় সুফল পাচ্ছে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশেও এ শিল্প বিপ্লবের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। আমাদের ব্যাংকগুলো প্রায় পুরোদমে অনলাইন ভিত্তিক চলছে। রবি-টেন মিনিট স্কুল, অন্যরকম পাঠশালা সহ মান সম্পন্ন কিছু অনলাইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজে শিক্ষকগণ অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন, আর শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই পাঠ গ্রহণ করছে। গণিত অলিম্পিয়াড সহ জাতীয়ভাবে স্বীকৃত অনেক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ইতোমধ্যে অনলাইনে শুরু হয়ে গেছে। সরকারও অনলাইন শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সম্প্রতি ‘আদালতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০’র খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর ফলে ভিডিও কনফারেন্স সহ অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আমরা সবাই দ্রুত একে অপরের কাছে এসে যাচ্ছি। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত সহ আমরা প্রায় সবাই ইন্টারনেটে সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছি। আমাদের কলকারখানাগুলোতেও অটোমেশনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। লেনদেন, যাতায়াত-যোগাযোগ, মার্কেটিং, কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য সহ প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা বিভিন্ন বিশেষ বিশেষ অ্যাপের সুফল পাচ্ছি। এভাবে পর্যায়ক্রমে আমাদের সবকিছুই দখল করে নিবে প্রযুক্তি। ধেয়ে আসবে রোবট। সর্বত্র জেঁকে বসবে অটোমেশন।  

কাজেই রোবোটিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তির জ্ঞান ও তার সঠিক ব্যবহারে আমাদের দক্ষ হয়ে ওঠার এখনই সময়। প্রযুক্তির জ্ঞান ও তার সঠিক ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠতে না পারলে আগামীর জীবনে আমাদের পথচলা খুবই কঠিন হয়ে যাবে। এমনকি বর্তমানেও অনেকের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। যিনি প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার জানবেন না, তিনি আগামীতে একজন অচল ও অশিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে সমাজে বিবেচিত হবেন। আবার যিনি প্রযুক্তির অপব্যবহার করছেন, তিনিও অকর্মণ্যরূপে সমাজের জন্য বোঝা হবেন। ছাত্রছাত্রীরা নিজ নিজ শ্রেণির বিষয় ও অধ্যায় ভিত্তিক পাঠ ভালোভাবে বোঝার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার করবে। অধ্যয়নের জন্য মানসম্পন্ন অনলাইন স্কুল ও বড় বড় লাইব্রেরিগুলোর ওয়েবসাইট ভিজিট করবে। তরুণরা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সৃজনশীল ও কর্মময় ক্যারিয়ার গড়বে। পেশাজীবীগণ প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজ নিজ পেশায় দক্ষতা অর্জন করবেন। এভাবে সবাই জীবনের সঠিক প্রয়োজনে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করবে- এটাই কাম্য। কিন্তু, দুঃখের বিষয়- আমাদের তরুণ সমাজের বেশিরভাগই এন্ড্রয়েড মোবাইল, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ সহ প্রযুক্তির বিভিন্ন ডিভাইসগুলোর সঠিক ও কার্যকরী ব্যবহারে দক্ষ হয়ে না উঠলেও কিন্তু, অপব্যবহার ও বাজে কাজে সময় অপচয় করতে বেশ পটু। কিশোর ও তরুণ সমাজকে এ অবস্থা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার। প্রযুক্তির ব্যবহার অবশ্যই মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ। এটা কোনোভাবেই যেন অভিশাপ না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের কড়া নজর রাখতে হবে- তারা যেন প্রযুক্তির অপব্যবহার না করে। বরং প্রযুক্তির জ্ঞান ও এর সঠিক ব্যবহারে দক্ষ হয়ে ওঠার মাধ্যমে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে তোলে। এক্ষেত্রে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের শিখন ও পঠন পদ্ধতিতে এবং ধ্যান-ধারণায় প্রযুক্তির ব্যবহারমুখী পরিবর্তন আনতে হবে। এভাবেই প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন ও তার সুব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যতে করোনার মতো যেকোনো দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে মানুষে মানুষে নিরাপদ দূরত্ব বা সোশ্যাল ডিসটেন্স বজায় রেখে জীবন ও জীবিকা উভয়ই ভালোভাবে রক্ষা করতে পারবো এবং যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তৌফিক দিন। আমিন।

 

[ব্লগটিতে অনেক তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। ব্লগটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমার পিতা বেলায়েত হোসাইন, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতিসংঘ বিদ্যালয় সংস্থা।]


শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে