এই ব্যাপারটি হয়ত আমাদের অনেকেরই খটকা লাগে যে আল্লাহ এক ও একক কিন্তু তিনি কিছু আয়াতে নিজেকে কেন আমরা বলে সম্বোধন করেছেন। আল্লাহ পবিত্র কুরআন শরিফে তার একত্ববাদের কথা ঘোষণা করে দিয়ে বলেছেনঃ বলুন, তিনি আল্লাহ, এক। (সুরা ইখলাস) কিছু আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আমরা বলার কারনে আমরা মুসলমানরা অনেক সময়ে এই ব্যাপারে একটু দ্বিধায় পড়ে যাই, যার একটা উদাহরণ দেয়া হলঃ আমরা আপনার কাছে মূসা ও ফিরআউনের কিছু বৃত্তান্ত যথাযথভাবে বিবৃত করছি এমন সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে যারা ঈমান আনে। (সুরা কাসাস ২৮ঃ৩) প্রশ্ন হল এই আমরাকেন?একবচন এর জায়গায় বহুবচন ব্যবহারের কারন কি? আরব দেশের মানুষদের ভাষা হল আরবি এইজন্য আল্লাহ তাদের বুঝার সুবিধার জন্য তাদের ভাষায় পবিত্র কুরআন শরীফ অবতীর্ণ করেছেন যাতে তাদের বুঝতে ব্যাকরণগত বা সাহিত্যগত কোন সমস্যা না হয়। আরবি সাহিত্যের রীতিতে আমি, সে এবং আমরা এর ব্যবহারঃ আমি বা আনা এর ব্যবহার - একজন ব্যক্তি হলে তার জন্য ‘আমি’ বা আনা (I) ব্যবহার করা হয়। সে বা হুয়া এর ব্যবহার - তৃতীয় ব্যক্তি হলে হুয়া বা তিনি ( He) ব্যবহার করা হয়। (স্ত্রী হলে হিয়া বলে) আমরা বা নাহনু এর ব্যবহার- আরবি সাহিত্যে কোনও ব্যক্তি নিজের সন্মান ও গৌরব প্রকাশের জন্য নাহনু বা আমরা ( We) ব্যবহার করতে পারেন। ‌অর্থাৎ আরবী বাক রীতিতে এক ব্যক্তি হলে ‘আমি’ বলে। মহান অর্থে ‘আমি’ এর জায়গায় ‘আমরা’ ও বলে। এটা কেবল কোরআন শরীফে নয়, আরবী সাহিত্যে প্রচুর দেখা যায়। যেমন, আরবিতে একজনকে নির্দেশ করতে বলা হয় ‘আলাইকা’ কিন্তু আমরা সালামের সময় আলাইকা না বলে বলি ‘আলাইকুম’ যার বাংলা অর্থ ‘আপনাদের ওপর’( অর্থাৎ শুদ্ধ অনুবাদ করলে হবে, আপনাদের উপর) । পবিত্র কুরআন শরীফ এর বাংলায় তরজমার সময় কোরআনে আল্লাহ যেভাবে বলেছেন সেভাবেই করা কর্তব্য। যেখানে আল্লাহ নিজেকে ‘আমি’ বলেছেন, সেখানে আমি। যেখানে ‘আমরা’ বলেছেন, সেখানে ‘আমরা’ বলাই শুদ্ধ। এই ‘আমরা’ বহু বচনের জন্য নয়, আল্লাহর মহত্ব ও গৌরব প্রকাশের জন্য। ইমামুন নাহব রযীউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (মৃত্যু : ৬৮৬ হি.) তার ‘আল ওয়াফিয়া শারহুল কাফিয়া’ গ্রন্থে বলেন: ‌ ويقول الواحد المعظم أيضا : نفعل وفعلنا، وهو مجاز عن الجمع لعدهم المعظم كالجماعة ‌ অর্থাৎ সম্মানী ও মহান ব্যক্তি একজন হল বহুবচনের সর্বনাম ব্যবহার করে বলেন, نفعل বা فعلن ।এটি বহুবচনের রূপকার্থ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। কারণ, একজন মহান ব্যক্তি একাই অনেক জনের সমষ্টিতুল্য। সেই ব্যক্তি যদি কোনো সম্রাট,বাদশাহ বা সম্রাজ্ঞী কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান হন তবে তো তাঁর সাথে থাকবে উপদেষ্টা ও পরামর্শদাতা এবং আজ্ঞাবহ বিভিন্ন বাহিনী। এই বিবেচনায় একজন মান্য ও মহৎ ব্যক্তির পক্ষে বহুবচনের সর্বনাম (আমরা) প্রয়োগ তাঁর গৌরব ও মাহাত্ম্যের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। এ ধরনের ব্যাখ্যাই হাফেজ সালাহুদ্দীন খলীল সাফাদী (মৃত্যু : ৭৬৪ হি.) পেশ করেছেন। দেখুন : নুছরাতুছ-ছায়ির আলাল মাছালিছ সায়ির (১/৭১, আল মাকতাবাতুশ শামিলা সংস্করণ) কুরআন ও বাইবেলের অনুবাদের জন্য ব্যবহৃত সর্বনাম Royal We বা রাজকীয় আমরা ( Royal WE কি?) ঃ একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে আশা করি, ইংল্যান্ডের রানী যখন তার সাম্রাজ্যের জন্য কোন অধ্যাদেশ জারী করতে চান তখন কখনোই একথা বলেন না, আমি এই আইন চালু করতে চাই.... তার পরিবর্তে বলেন, আমরা এই আইন চালু করতে চাই..... আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে.....। এখানে আমি র পরিবর্তে আমরা বলাটাই বেশি সন্মানের। এখানে এই আমরা হল Royal We. ধরুন নেপালে ভয়াবহ ভুমিকম্প হল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে সমবেদনা জানানোর জন্য সেখানে গেলেন আর সমবেদনা জানাতে গিয়ে যদি বলেন, আমি এই বিপদে আপনাদের সাথে আছি তার চেয়ে অনেক সন্মান ও গৌরবের এই কথা বলা যে, আমরা এই বিপদে আপনাদের সাথে আছি এই কথা দ্বারা বাংলাদেশের সব ধরনের শক্তি এবং সামর্থ্য নিয়ে তাদের সাথে থাকাকে বুঝায়। এখানে এই আমরা হল Royal We. আর আল্লাহ তায়ালা হলেন সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতিপালক, সমস্থ সম্রাট আর বাদশাহদের বাদশাহ যিনি সবাইকে রাজত্ব দান করেন আর যখন চান ছিনিয়ে নেন। পৃথিবীর সমস্থ বাদশাহরা সব সময়ে ভীত থাকে কখন তার রাজত্ব হাত ছাড়া হয়ে যায় বা কখন মৃত্যু এসে ওলট পালট করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা এ সমস্থ ভয় ভীতি থেকে দুরে।সমস্থ ফেরেশতারা তার ভয়ে কাপতে থাকে, আকাশ জমিন তার হুকুমের সামনে নত হয়ে যায়...... সেই আল্লাহই নিজের প্রতাপ আর উনি যে সমগ্র বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক তা প্রকাশ করার জন্যই আর নিজেকে গর্বিত করার জন্যই রাজকীয় আমরা বা Royal We ব্যবহার করেন। ফার্সি-উর্দু-হিন্দীতে কি সাহিত্যের ভাষা, কি কথ্য ভাষা উভয়টাতেই সমানভাবে বক্তাপক্ষ ও শ্রোতাপক্ষের সর্বনামে সম্মানার্থে বহুবচনের প্রয়োগ অনেক আগে থেকেই সুপ্রচলিত। এছাড়া উর্দূ-হিন্দীতে ‘আপ’এই বিশেষ সর্বনামটি সম্মানার্থে শ্রোতা ও অন্যপক্ষের জন্যে ব্যবহার হয়ে থাকে। (‘হাম’ ও ‘তোম’ শব্দ দুটি) এবং ‘উর্দু ছারফ ও নাহব’, বাবায়ে উর্দু, ড. আব্দুল হক, উর্দু একাডেমী, করাচি (যমীরের আলোচনা) বাংলাসহ ইংরেজি, ফার্সি, হিব্রু, আরবি ইত্যাদি অনেক ভাষাতেই এই রাজকীয় “আমরা” সর্বনামের ব্যবহার রয়েছে। এটি ভাষার একটি মর্যাদাগত দিক। বিশেষকরে ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি লক্ষ্যনীয়।