আর সকাল-সন্ধ্যায় তোমার প্রভুকে স্মরণ করতে থাকো মনে মনে একান্ত বিনয়ের সঙ্গে, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এবং অনুচ্চ স্বরে, আর তুমি উদাসীন হয়ো না। (সুরা : আরাফ, আয়াত : ২০৫) তাফসির : এ আয়াতে আল্লাহর জিকির ও তার আদব-কায়দা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে অবশ্য কোরআন তেলাওয়াতও অন্তর্ভুক্ত। নীরব ও সরব জিকিরের বিভিন্ন আহকাম : আলোচ্য আয়াত থেকে জিকিরের তিনটি পদ্ধতি জানা যায়। প্রথমত, আধ্যাত্মিক জিকির। অর্থাৎ যে জিকির কল্পনা ও চিন্তার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এর সঙ্গে জিহ্বার সামান্য স্পন্দনও হবে না। দ্বিতীয়ত, যে জিকিরে আত্মার চিন্তা-কল্পনার সঙ্গে সঙ্গে জিহ্বাও নড়বে। তবে তাও আওয়াজ অন্যরা শুনতে পাবে না। আর তৃতীয় পদ্ধতি হলো অন্তরে উদ্দিষ্ট সত্তার উপস্থিতি ও ধ্যান করার পাশাপাশি জিহ্বার স্পন্দনও হবে এবং সেই সঙ্গে শব্দও বের হবে, কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আওয়াজকে অধিক উচ্চ করবে না। তবে সরব ও নীরব জিকিরের মধ্যে কোনটি উত্তম, তার ফয়সালা ব্যক্তি ও অবস্থাভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে। কারো জন্য জোরে, আর কারো জন্য আস্তে জিকির করা উত্তম। এ আয়াতে মূলত জিকিরের তিনটি বিশেষ আদব তুলে ধরা হয়েছে। এক. জিকির মনে মনে করা। দুই. জিকির নম্রতা ও বিনয়ের সঙ্গে করা। তিন. ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অর্থাৎ জিকিরের সময় অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি সঞ্চারিত হতে হবে। আর সুরা আরাফে নীরবে ও গোপনে জিকির করার কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : তোমরা নিজ পালনকর্তাকে ডাকো বিনীতভাবে ও সংগোপনে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না। (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৫৫) জিকিরের উত্তম পদ্ধতি : কোরআন ও হাদিসের বহু স্থানে আল্লাহর জিকির করার প্রতি বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জিকির আস্তে করবে, না জোরে করবে এ নিয়েও সমাজে মতপার্থক্য দেখা যায়। সুরা আরাফের আয়াত থেকে আস্তে জিকির করা উত্তম বলে প্রমাণিত হয়। খায়বর যুদ্ধে সাহাবায়ে কেরামের তাকবির ধ্বনি উচ্চস্বরে হয়ে গেলে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে জনগণ, নরম হও, বিনম্র আওয়াজে ডাকো...তোমরা কোনো বধির বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকছ না। (মুসলিম) হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, পূর্ববর্তী মনীষীরা বেশির ভাগ সময় আল্লাহর জিকির ও দোয়ায় মশগুল থাকতেন; কিন্তু কেউ তাঁদের আওয়াজ শুনতে পেত না। তবে শরিয়তে যেসব স্থানে সরব ও উচ্চস্বরে জিকির করার নির্দেশ দিয়েছে, সেখানে সরব জিকির উত্তম। যেমন-আজান, ইকামত, কোরআন তিলাওয়াত, নামাজের তাকবির, তাকবিরে তাশরিক ও হজের লাব্বাইকা ইত্যাদি উচ্চস্বরে বলা উত্তম। আর অন্যান্য ক্ষেত্রে উচ্চস্বরে জিকির করার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। এক. এতে লোক দেখানো মনোভাব থাকতে পারবে না। দুই. নিজের জিকিরের শব্দে অন্যের নামাজ, তেলাওয়াত, কাজকর্ম বা বিশ্রামে ক্ষতি করা যাবে না। তিন. জিকিরের এ পদ্ধতিকেই একমাত্র সঠিক পদ্ধতি হিসেবে জ্ঞান করা যাবে না। জিকিরের প্রকারভেদ : আসলে কেবল মুখে উচ্চারণের নামই জিকির নয়। জিকির সাধারণত তিন প্রকার। প্রথমত, জিকিরে লিসানি বা মৌখিক জিকির। দ্বিতীয়ত, জিকিরে কালবি বা আন্তরিক জিকির। তৃতীয়ত, জিকিরে আমালি বা কর্মগত জিকির। জিকিরে লিসানি হচ্ছে মুখে মুখে আল্লাহু, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ প্রভৃতি উচ্চারণ করা। এ প্রকার জিকির মুখ-জিহ্বা অন্য কোনো শব্দ উচ্চারণে ব্যস্ত না থাকলে অধিকাংশ সময় করা যায়। তবে খাদ্য গ্রহণকালে, মুখে খাদ্য চিবানো অবস্থায় এবং প্রস্রাব-পায়খানাকালে জিকির করা যায় না। জিকিরে কালবি আক্ষরিক অর্থেই সার্বক্ষণিক জিকির। মোমিন তার কলবে আল্লাহর স্মরণ সদা জাগরূক রেখে এবং মনেপ্রাণে আল্লাহকে অবিস্মৃত রেখে পার্থিব-অপার্থিব সব কাজ করতে পারেন। যে কলবে আল্লাহর জিকির জারি থাকে, সে কলব অনুক্ষণ প্রশান্তময় থাকে। জিকিরে আমালি হচ্ছে মোমিনের ফরজ-নফলসহ সব ধরনের ইবাদত-বন্দেগি। এ অর্থে যেকোনো নামাজ, হজ, ওমরাহ বা যেকোনো দোয়া-মোনাজাত প্রভৃতিও জিকির বা আল্লাহর জিকির। মুমিনদের জন্য জীবনের সর্বক্ষেত্রে কোনো না কোনো উপায়ে আল্লাহকে স্মরণ করতেই হবে। আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল হওয়ার সুযোগ নেই। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন ও ইবনে কাছির অবলম্বনে)