hasanrpi

Call
আমার আদর ও ভালোবাসা নিও। অনেক দিন তোমাকে দেখি নাআমার খুব কষ্ট হয়। কান্নায় আমার বুক ভেঙে যায়। আমার জন্য তোমার কী অনুভূতি আমি জানি না। তবে ছোটবেলায় তুমি আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে না। আমি যদি কখনও তোমার চোখের আড়াল হতাম মা মা বলে চিৎকার করতে। মাকে ছাড়া কারও কোলে তুমি যেতে না। সাত বছর বয়সে তুমি আমগাছ থেকে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিলে। তোমার বাবা হালের বলদ বিক্রি করে
image
তোমার চিকিৎসা করিয়েছেন। তখন তিন দিনতিন রাত তোমার পাশে না ঘুমিয়েনা খেয়েগোসল না করে কাটিয়েছিলাম। এগুলো তোমার মনে থাকার কথা নয়। তুমি একমুহূর্ত আমাকে না দেখে থাকতে পারতে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বিয়ের গয়না বিক্রি করে তোমার পড়ার খরচ জুগিয়েছি। হাঁটুর ব্যথাটা তোমার মাঝে মধ্যেই হতো। বাবা... এখনও কি তোমার সেই ব্যথাটা আছেরাতের বেলায় তোমার মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে তুমি ঘুমাতে না। এখন তোমার কেমন ঘুম হয়আমার কথা কি তোমার একবারও মনে হয় নাতুমি দুধ না খেয়ে ঘুমাতে না। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার কপালে যা লেখা আছে হবে। আমার জন্য তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি খুব ভালো আছি। কেবল তোমার চাঁদ মুখখানি দেখতে আমার খুব মন চায়। তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে। তোমার বোন.... তার খবরাখবর নিও। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলো আমি ভালো আছি। আমি দোয়া করিতোমাকে যেন আমার মতো বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে না হয়। কোনো এক জ্যোস্না ভরা রাতে আকাশ পানে তাকিয়ে জীবনের অতীতবর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু ভেবে নিও। বিবেকের কাছে উত্তর পেয়ে যাবে। তোমার কাছে আমার শেষ একটা ইচ্ছা আছে। আমি আশা করি তুমি আমার শেষ ইচ্ছাটা রাখবে। আমি মারা গেলে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে আমাকে তোমার বাবার কবরের পাশে কবর দিও। এজন্য তোমাকে কোনো টাকা খরচ করতে হবে না। তোমার বাবা বিয়ের সময় যে নাকফুলটা দিয়েছিল সেটা আমার কাপড়ের আঁচলে বেঁধে রেখেছি। নাকফুলটা বিক্রি করে আমার কাফনের কাপড় কিনে নিও। তোমার ছোটবেলার একটি ছবি আমার কাছে রেখে দিয়েছি। ছবিটা দেখে দেখে মনে মনে ভাবি এটাই কি আমার সেই খোকা!’ এভাবে বেদনা ভরা একটি খোলা চিঠি ছেলের উদ্দেশে লিখেছেন মদিনা খাতুন (ছদ্মনাম)। মদিনা খাতুনের বয়স এখন আশি। ছয় বছর আগে তার আশ্রয় জুটেছে বৃদ্ধাশ্রমে।
স্বামী-সন্তানদের নিয়ে অনেক ঈদ উদযাপন করেছেন তিনি। বৃদ্ধাশ্রমে আসার পর এই বৃদ্ধাশ্রমের বুড়ো-বুড়িরাই তার এখন আপনজন। তাদের সঙ্গেই কয়েক বছর ধরে তিনি ঈদ উদযাপন করেন। মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বিদেশ পাড়ি দিয়েছে। একমাত্র ছেলে একজন সরকারি কর্মকর্তা। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেশ ভালোই আছেন। সেই সুখের সংসারে মায়ের ঠাঁই হয়নি। ছেলে বাড়িতে বিদেশী কুকুর রেখেছে। সেখানে কুকুরটির থাকার জন্য একটি সুন্দর ঘর রয়েছে। তিন বেলা কুকুরটিকে ভালো খাবার দেয়া হয়। মায়ের প্রতি সন্তানের এই অবহেলার কারণ জানা নেই এই হতভাগা মায়ের।
মদিনা বেগম শুধু এটুকুই বলেনএকমাত্র বুকের ধন কলিজার টুকরা ছেলেকে ছয় বছর ধরে দেখি না। ছেলেকে দেখতে মন খুব আনচান করে। নাতির বয়স প্রায় আট বছর। তার কথা খুব মনে পড়ে। বুকে জড়িয়ে আদর করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু আমার কপালে লেখা রয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে বাস।
এই বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধরাই
আমার আপনজন
মর্জিনা খাতুন (৮৫) নিঃসন্তান। বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। এক বছর ধরে এখানে থাকছেন। বোন-ভাগিনা তার দেখাশোনা করতেন।
মর্জিনা খাতুন বলেনছেলেমেয়ে নেই। কোথায় যাব। লোকমুখে এই বৃদ্ধাশ্রমের কথা শুনে এখানে আশ্রয় নিলাম। বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দিতে চাই। একাকী জীবনে আবার ঈদের আনন্দ। এখানে আসার পর দুটো ঈদ গেল। সমবয়সীদের সঙ্গে ঈদ করছি। আগে তো আপনজনদের ছাড়া কখনও ঈদ করিনি। এই বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধরাই আমার আপনজন।
যার স্বামী অন্য নারীকে নিয়ে
থাকছে তার আর ঈদ কী!
গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলার নাগরী থেকে এসেছেন দায্য মনি (৭০)। তার দুই মেয়েমেয়েজামাইদুই ছেলেকে নিয়ে ভরা সংসার ছিল। এরপরও স্বামী অন্য এক নারীকে নিয়ে সংসার করছে।
দায্য মনি বলেনজীবনের শেষ মুহূর্তে স্বামীসন্তাননাতি-নাতনি নিয়ে সুখে দিন কাটাব। এমনটাই স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বামীর আচরণে সেই সুখ আমার কপালে সইল না। এই অন্যায় মেনে নিতে মন সায় দিল না। তাই ছেলেমেয়েনাতি-নাতনিকে দূরে রেখে এখানে আশ্রয় নিয়েছি। যার স্বামী অন্য নারীকে নিয়ে থাকছে তার আর ঈদ কী!
বৃদ্ধাশ্রমের লোকেরাই
আমার ছেলেমেয়ে
আনোয়ারা বেগম (৮০) বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। তার পরও ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলেনআমার ছেলেমেয়ে নেই। একটা মেয়ে থাকলে হয়তো তার হাত ধরে বেঁচে থাকতে পারতাম। কথায় আছে, ‘বন্যেরা বনে সুন্দরশিশুরা মাতৃক্রোড়ে’, ঠিক তেমনিই বুড়ো বয়সে বাবা-মা সুন্দর তার নিজ সন্তানের ঘরে। এখন আল্লাহই আমার সবএই বৃদ্ধাশ্রমের লোকেরাই আমার ছেলেমেয়ে। তাদের সঙ্গেই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।
বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের
কর্মকর্তারা যা বললেন
বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আবু শরীফ জানানদুই শতাধিক সহায়-সম্বলহীন নারী-পুরুষ এখানে রয়েছেন। ঈদ উপলক্ষে বৃদ্ধাদের নতুন শাড়িব্লাউজপেটিকোট ও জুতা দেয়া হয়েছে।
পুনর্বাসন কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. এমএম জাহিদুল ইসলামের মতেঅসুস্থদের চিকিৎসার জন্য মেডিকেল সার্ভিসটিভি দেখার জন্য হলরুমনারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা ডাইনিং এবং মসজিদে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। হিন্দুমুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মের প্রবীণ ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাদের নিজ নিজ ধর্মমতে শেষকার্য সম্পন্ন করে আলাদাভাবে দাফন অথবা শেষকৃত্য সম্পন্ন করা। 
যুগান্তর পত্রিকা থেকে এই লেখা সংগ্রহ করা হয়েছে। পত্রিকা থেকে লেখাতি পরত্র এখানে ক্লিককরুন।