manik

Call

প্রায় আট দশক আগের কথা। তখনও ব্রিটিশ সূর্য অস্ত যায়নি ভূ-ভারতের চৌহদ্দি থেকে। ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী দক্ষিণ দিল্লির এক জেলার নাম গৌড়গানো। তারই এক নিভৃত জনবিরল অঞ্চল 'মেওয়াত'। সেখানে কোনো না কোনো গৃহকোণে প্রতি মাসে অন্তত একবার বসতো তাবলিগি জলসা। বয়ান করতেন মুরুব্বিরা। আর অনতিদূর থেকে আসতেন 'ইলম'পিপাসুরা। এভাবেই চলছিল। ছড়িয়ে পড়ছিল সু-সমাচার। মেওয়াত-এ দাওয়াতে তাবলিগি জামায়াতের গোড়াপত্তনের কয়েক দশক পর, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে নিযামউদ্দীন মসজিদের নূহ মাদ্রাসায় প্রথম বড় পরিমণ্ডলে তাবলিগি ইজতেমার সূচনা হয়েছিল। ৮, ৯ ও ১০ যিলকদ ১৩৬০ হিজরি, মোতাবেক ২৮, ২৯ ও ৩০ নভেম্বর ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। মেওয়াতভূমির মানুষেরা এমন বড় সমাবেশ ইতিপূর্বে আর দেখেনি। ধারণামতে লোকসংখ্যা ছিল বিশ-পঁচিশ হাজার। এদের একটা বিরাট অংশ নিজের সামান আর নিজের খাবারদাবার কাঁধে করে ত্রিশ-চল্লিশ ক্রোশ পথ হেঁটে হাজির হয়েছিলেন। বহিরাগত বিশিষ্ট মেহমানদের সংখ্যা ছিল হাজার খানেক। তারা ছিলেন শানদার মেহমানদারিতে। জুমাবাদ জলসা শুরু হলো। সকাল থেকে রাত অবধি জলসা চলত। না ছিল কোনো সভাপতি, না ছিল অভ্যর্থনা কমিটি কিংবা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। কিন্তু যাবতীয় ব্যবস্থা ও কার্যক্রম অতি সুচারুভাবে আঞ্জাম হয়ে যায়। সেই ইজতেমায় 'হে মুসলিম ভাইয়েরা, তোমরা সত্যিকারের মুসলমান হও'—এই ছিল মর্মবাণী। সেই দাওয়াতি জলসার জৌলুশমাখা পথ ধরে তারপর ফি বছর চলছিল এই মাহফিল। তখনও তাবলিগ জামায়াতের দাওয়াত পৌঁছেনি এই বঙ্গভাগে। প্রথম যুগে 'শওক' ও 'জযবার' সাথে ফায়দা হাসিলের যে 'মেহনত' চলছিল তা হযরত মাওলানা আবদুল আজিজের (রহ.) মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে এসে পৌঁছে বাংলাদেশে। তবে তারও দু-বছর পরে এদেশে 'বিশ্ব ইজতেমা'র ঐতিহাসিক পটভূমি রচিত হয়েছিল কাকরাইল মসজিদে ছোট আয়তনে। অতঃপর এই মারকাজ ছেড়ে ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম হাজি ক্যাম্পে, ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে, ১৯৬৫ সালে টঙ্গির পাগারে এবং অবশেষে ১৯৬৬ সালে টঙ্গির তুরাগ নদীর (কহর দরিয়া) উত্তর-পূর্ব তীর সংলগ্ন ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা ময়দানে বিশ্ব ইজতেমায়-বিশ্ব তাবলিগের পুনর্জাগরণ ঘটে। ১৯৯৬ সালে তত্কালীন সরকার এ জায়গায় ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয় এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটায়। 'বিশ্ব ইজতেমা' শব্দটি বাংলা ও আরবি শব্দের বন্ধন। আরবি 'ইজতেমা' অর্থ সম্মিলন, সভা বা সমাবেশ। ভারতের মুম্বাই ও ভূপালে এবং হালে পাকিস্তানের রায়বেন্ডে বিশ্ব ইজতেমা হলেও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমাই বড়। গোটা দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে আগত তাবলিগিদের বৃহত্ এই ইজতেমা দিনে দিনে নতুন মাত্রা ধারণ করছে। তবে এর সূচনার ইতিহাসটি মসৃণ ছিল না। বড় বড় চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভারতবর্ষের মুসলমানদের এক ক্রান্তিকালে বিংশ শতাব্দীর ইসলামি চিন্তাবিদ ও সাধক হযরত মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভী (১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রি.) দাওয়াতে তাবলিগির পুনর্জাগরণ ঘটান। দিল্লির স্খলিত চরিত্র, ধর্ম-কর্মহীন, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন নামেমাত্র মুসলমান 'মেও' জনগোষ্ঠীকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস, ধর্মের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন ও কলেমার দাওয়াতি মর্ম শিক্ষাদান এবং বিভ্রান্তির কবল থেকে মুক্ত করার ব্রত নেন। হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) অনুধাবন করেছিলেন যে, জনগণের বৃহত্তর অংশে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সুদৃঢ়করণ ও তার বাস্তব অনুশীলন না হলে মানবসমাজে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। বরং সাধারণ মানুষের জীবনে দ্বীন ইসলাম না আসলে মুমিন হতে পারে না। ১৩৪৫ হিজরিতে দ্বিতীয় হজ থেকে ফিরে এসে তিনি তাবলিগি গাশ্ত শুরু করলেন, জনসাধারণের মাঝে কলেমা ও নামাজের দাওয়াত দিতে লাগলেন। তাবলিগ জামায়াত বানিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বের হওয়ার দাওয়াত দিলেন। এভাবে গ্রামে গ্রামে কাজ করার জন্য জামায়াত তৈরি করে দিতেন। কয়েক বছর মেওয়াতে এ পদ্ধতিতে কাজ অব্যাহত থাকল। ১৩৫২ হিজরিতে তৃতীয় হজ পালনের পর তিনি বুঝতে পারলেন যে, গরিব মেওয়াতী কৃষকদের পক্ষে দ্বীন শেখার সময় পাওয়া কষ্টকর। তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরানো দশা। ঘর-সংসার ছেড়ে মাদ্রাসায় দ্বীন শেখাও অসম্ভব। ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে সামগ্রিক জীবন পাল্টে দেওয়া বা জাহেলি বিশ্বাসকে পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। তাই একমাত্র উপায় হিসেবে তাদের ছোট ছোট জামায়াত আকারে ইলমি ও দ্বীনি মারকাজগুলোতে গিয়ে সময় কাটানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন এবং ধর্মীয় পরিবেশে তালিম দিতে আরম্ভ করলেন। সেই ধর্মীয় মজলিসে উলামা-মাশায়েখদের ওয়াজ-নসিহতের পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন জীবনের নিয়মনীতি বাতলে দেওয়া হতো। দ্বীনদার পরহেজগার লোকদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চালচলন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। ধর্মীয় মৌলিক বিশ্বাস ও ইবাদতের অনুশীলনের পাশাপাশি তিনি মুসলমানদের অনুসৃত প্রধান ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনের প্রয়োজনীয় কিছু সূরা- কেরাত শিক্ষাদান, দোয়া-দরুদ, জরুরি মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে অবহিত করে তাঁর তাবলিগি জামায়াতকে একটি ভ্রাম্যমাণ মাদ্রাসাতে রূপান্তরিত করেন। প্রায় প্রতি মাসে একবার মেওয়াতের কোনো না কোনো স্থানে এবং বছরে একবার 'নূহ' অঞ্চল মাদ্রাস তাবলিগি জলসা হতো। দিল্লির তাবলিগি জামায়াত, ব্যবসায়ী দল, নিযামুদ্দীনে অবস্থানকারী জিম্মাদারগণ এবং মাযাহেরুল উলুম সাহারানপুর, দারুল উলুম দেওবন্দ, দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা ও দিল্লি ফতেহপুর মাদ্রাসার কতিপয় আলেম ও শিক্ষক তাতে অংশগ্রহণ করতেন। হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রাহ.) বিশিষ্ট তাবলিগি সাথিদের নিয়ে জলসার উদ্দেশে রওনা হতেন। সফরের সারা পথ দাওয়াত দিয়ে যেতেন। দেশ-কাল পেরিয়ে এভাবেই পর্যায়ক্রমে তাবলিগের বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার ঘটে। প্রথম ইজতেমা সম্পর্কে হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী তাঁর 'একটি নূরানী ইজতিমা' ও 'হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. ও তাঁর দ্বীনী দাওয়াত' গ্রন্থে জানাচ্ছেন, ৮, ৯ ও ১০ যিলকদ ১৩৬০ হিজরি, মোতাবেক ২৮, ২৯ ও ৩০ নভেম্বর ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দিল্লির নিযামউদ্দীন মসজিদের ছোট এলাকা মেওয়াতের নূহ মাদ্রাসায় যে তাবলিগি ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়, মেওয়াতভূমির মানুষেরা এত বড় সমাবেশ ইতিপূর্বে আর দেখেনি। বাস্তবানুগ ধারণামতে, লোকসংখ্যা ছিল বিশ-পঁচিশ হাজার। এদের একটা বিরাট অংশ নিজের সামান ও নিজের খাবারদাবার কাঁধে করে ত্রিশ-চল্লিশ ক্রোশ পথ হেঁটে হাজির হয়েছিলেন। বহিরাগত বিশিষ্ট মেহমানদের সংখ্যাও হাজারের কাছাকাছি ছিল। তারা মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার ভবনে শানদার মেহমানদারিতে ছিলেন। মজমার সুপ্রশস্ত শামিয়ানার নিচে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.) জুমার নামাজ পড়িয়েছিলেন। জামে মসজিদসহ প্রায় মসজিদে নামাজ হওয়া সত্ত্বেও প্রধান জামাতের কাতারের কারণে সড়ক চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ছাদে ও বালাখানার ওপরেও শুধু মানুষ আর মানুষ দেখা যাচ্ছিল। তবে শুরুতে তাবলিগি কাজ ব্যাপক সমর্থন পায়নি। ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এ ব্যাপারে হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর ন্যায়নিষ্ঠা, ধৈর্য, পরিশ্রম, পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অপরিসীম ভূমিকা রাখে। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) সারাজীবন পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে এই দাওয়াত ও তাবলিগ জামায়াত তথা বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ঐক্যের প্রতীক বিশ্ব ইজতেমাকে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক সুদৃঢ় ও শক্তিশালী অবকাঠামোর ওপর স্থাপন করে ১৯৪৪ সালের ১৩ জুলাই ৫৯ বছর বয়সে ইহকাল ত্যাগ করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর বিশ্ব মুসলিম ঐক্য ভ্রাতৃত্বের প্রতীক বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় প্রধান মুবাল্লিগ নিযুক্ত হন তাঁর সুযোগ্য পুত্র হযরত মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.)। তিনি তাবলিগের দাওয়াতী জামায়াতকে ভারতের চৌহদ্দি থেকে বের করে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছাতে থাকেন। এই তাবলিগের দাওয়াতের সূত্র ধরেই মুসলিম ঐতিহ্যের স্পেনের মাটিতে ৫০০ বছর পর মসজিদের মিনারে আজানের সুমধুর আওয়াজ ধ্বনিত হয়। দ্বিতীয় আমির মাওলানা ইউছুফ কান্ধলভীর (রহ.) যুগে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এর আন্দোলন সবচেয়ে বেশি ও শক্তিশালী হয়। এরপরই ক্রমেই তাবলিগের কার্যক্রম বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের গন্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিশ্বের সর্বত্র। হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.)-এর মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে তাবলিগ শুরু হয়। বার্ষিক ইজতেমার প্রয়োজন অনুভব করে হযরত মাওলানা ইউছুফ কান্ধলভী (রহ.) মুরুব্বিদের নিয়ে পরামর্শ করেন। বৈঠকে বাংলাদেশের নাম বেরিয়ে আসে। তাবলিগ জামায়াতের সদর দফতর দিল্লিতে থাকা সত্ত্বেও এর বার্ষিক সমাবেশের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেয়া হয়। আর সেই থেকেই বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের প্রতীক মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় সর্ববৃহত্ সমাবেশ ও মহাসম্মেলন বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে এসে নয়া দিগন্তে পৌঁছে। সাধারণত প্রতি বছর শীতকালে এই সমাবেশের আযোজন করা হয়ে থাকে, এজন্য ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসকে বেছে নেয়া হয়। পুরো সমাবেশের আয়োজনই করে থাকেন একঝাঁক ধর্মপ্রাণ মুসলমান স্বেচ্ছাসেবক—আর্থিক, শারীরিক সহায়তা দিয়ে প্রথম থেকে শেষাবধি তারা এই সমাবেশকে সফল করতে সচেষ্ট থাকেন। পুরো সমাবেশস্থলটি একটি উন্মুক্ত মাঠ, যা বাঁশের খুঁটির ওপর চট লাগিয়ে ছাউনি দিয়ে সমাবেশের জন্য প্রস্তুত করা হয়। শুধু বিদেশি মেহমানদের জন্য টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়ার ব্যবস্থা করা হয়। সমাবেশস্থলটি প্রথমে খিত্তা ও পরে খুঁটি নম্বর দিয়ে ভাগ করা হয়। অংশগ্রহণকারীগণ খিত্তা নম্বর ও খুঁটি নম্বর দিয়ে নিজেদের অবস্থান শনাক্ত করেন। তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলাওয়ারি মাঠের বিভিন্ন অংশ ভাগ করা থাকে। বিদেশি মেহমানদের জন্য আলাদা নিরাপত্তাবেষ্টনীসমৃদ্ধ এলাকা থাকে, সেখানে স্বেচ্ছাসেবকরাই কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, কোনো সশস্ত্র বাহিনীর অনুপ্রবেশের অধিকার দেওয়া হয় না। সাধারণত তাবলিগ জামাতের অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্ন তিন দিন মহান আল্লাহর পথে কাটানোর নিয়ত বা মনোবাঞ্ছা পে